যাত্রা শুরুঃ একটি অন্যরকম পাথরের গল্প

ফিলোসফারস স্টোন।

হ্যারী পটার যখন পড়তাম গোগ্রাসে, মূল ভিলেইন ভোল্ডেমর্টের ফিলোসফারস স্টোনের পেছনে ছুটে চলায় কত্তদিন বুঁদ হয়ে ছিলাম! সেই “ফিলোসফারস স্টোন” যা বদলে দিতে পারে, বদলে দেয়। টমাস মারভালো রিডল তথা ভোল্ডেমর্ট এর পর আরো একজনের সাথে পরিচয় হয় যে হন্যে হয়ে ফিলোসফারস স্টোন খুঁজে বেড়াতো, তার মাকে ওপারের জগত থেকে ফিরিয়ে আনবে বলে। কি সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা,কি সেই মনোবল! কি কঠিন যুদ্ধই না সেই ১২ বছরের বাচ্চাটি করেছে তার প্রাণপ্রিয় আম্মু আর আদরের ছোট্ট ভাইটার হারিয়ে যাওয়া শরীর ফিরিয়ে আনতে! সেই আন্তরিকতা আর পাহাড়সমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সামনে মরণকেও সে কেয়ার করেনি। Full Metal Alchemist Brotherhood এর এডভেঞ্চার যারা দেখেছে তারাই জানে “সত্যিকারের খুঁজে বেড়ানো” কাকে বলে।

11

দীপেশ সেদিন বাসায় এসে বলছিলো,

“তোর দেয়া স্ট্যাটাস টা পড়লাম। আরে, যে আপুটার বদলে যাওয়ার গল্প লিখলি তার চেয়ে তোর বদলানোর গল্পটাতো আরো মজার ছিলো। ভার্সিটির ফার্স্ট দুই বছরে তুই কি ছিলি, আর শেষ দুই বছরেকি হলি, সেটা শেয়ার কর।”

আমার লজ্জা লাগে বলতে। এ যে একান্তই নিজের করা যুদ্ধের কথা। একা একা ভূল পথে, ভূল গলিতে হন্যে হয়ে হোঁচট খাওয়া আর হেঁটে বেড়ানোর গল্পের কথা বলতে কার ভালো লাগে? ভূল আর নষ্ট অতীত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, তাকে কেন আবার খুঁড়ে বের করে দুর্গন্ধ করা চারিপাশ? পরে ভাবলাম, এই অতীতই তো আমার শক্তি, আমার এগিয়ে চলার সাহস আর প্রেরণা। কেউ যদি একটুও সাহস পায় এই গল্প থেকে, কেউ যদি সত্যের পথে, সত্যের জন্যে আপোষহীন হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়ে যায়? বলা তো যায়না।

গাপুসগুপুস করে আমি বই খেতাম সেই ছোট্টবেলা থেকে। সবাই খেলা দেখতো,আমি বই খেতাম। বন্ধুরা আড্ডা দিতো, আমি বই পান করতাম। বন্ধুরা টিভিতে বুঁদ হয়েথাকতো, আমি বইয়ে ডুবে হাঁসফাঁস করতাম। বই ছিলো আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। প্রিয় খাবার,পানীয়, বালিশ, জগত সবই ছিলো আমার বইময়। এমন কোন বই ছিলোনা যা আমি পড়তামনা। ইন্টার পাশ করার পর হুমায়ুন আজাদের “আমার অবিশ্বাস” বইটি গেলার পর পেটে খুব গ্যাস ফর্ম করে। খুব পানি খেয়ে, রেস্ট নিয়ে পেটের গ্যাস দূর হলো, কিন্তু মাথায় ঠিক ঠিক গ্যাস্ট্রিক হয়ে গেলো।

স্রস্টা কি সত্যিই আছেন? নাকি সব মানুষের বানানো গালগপ্পো? হুম্ম? ধর্ম-টর্ম কি আসলে বানানো কিছু হাস্যকর “রিচুয়ালস” না? সমাজের গড়ে তোলা সংস্কারভীতু মন বলে ওঠে, “না না, বাদ দাও তো ওসব ফালতুকথা। ওসব ভাবতে নেই।” যুক্তি বলে, “না না তো করছো, ভিত্তি আছে এই বিশ্বাসের? ভীতু কাপুরুষ কোথাকার!” মেজাজ খাট্টা হয়ে গেলো। কি করা যায়? কি করা যায়? পারিতো খালি একটাই কাজ। পড়া। তো, শুরু হয়ে গেলো আরকি।

পড়তে পড়তে আরজ আলী মাতুব্বর থেকে বার্ট্রান্ড রাসেল, কুরানের অনুবাদ থেকে শুরু করে বেদ-গীতা-বাইবেল কিচ্ছু বাদ থাকলোনা। একটাই লক্ষ্য, যেটা সত্যি সেটাকে খুঁজে বের করবো, শুধু সেটাই মানবো। সত্যের সাথে কোন আপস চলবেনা, চলতে পারেনা। ধর্মগ্রন্থগুলোর অনুবাদ পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে এতদিন সব ফালতু বিশ্বাস মেনে এসেছি?! হায় হায়! বন্ধ করো এসব। কেন মিলাদ পড়ো? নামাজ কেন পড়ো? মাজারে যাও কেন? মুসলিমই যদি হও তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কেন পড়োনা? নিজেকে মুসলিম বলো কি বুঝে? দেব-দেবীর পুজা করছো ভালো কথা, জেনে বুঝে করছোতো? ঘরে-বাইরে, বন্ধু-সহপাঠি, ঈদ-পুজায় সবখানে সবাইকে জ্বালিয়ে মারতাম। কেউ কিচ্ছু জানতোনা। উত্তর দিতে পারতোনা কেউ। সব্বাই হই-হই করে উঠতো “মাইরালামু-কাইট্টালামু” সরগোল তুলে। সার্টিফিকেটধারী বেকুবের দলকে চিনে গেলাম, চিনে গেলাম হাস্যকর জ্ঞানার্জনের সিস্টেমটাকে আর সেই সিস্টেম থেকে বিজবিজ করতে করতে বেরিয়ে আসা অন্ধ মেরুদন্ডহীনদের। অন্ধবিশ্বাস আর এন্টারটেইনমেন্টের (খেলা, মুভি, টিভি, গেইমস ইত্যাদির) নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা একটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজ আবিষ্কার করে অনেকদিন অ-নে-কদিন হতাশায় ভুগেছি, আর তামাক পুড়ে ছাই করেছি।

হতাশা ধীরে ধীরে ঘৃণাতে আর ঘৃণা থেকে আস্তে আস্তে বেড়ে ঊঠলো অহংকার। খুব পড়তাম, আর সবাইকে যেখানেই পেতাম ধুয়ে দিতাম । এক্কেবারে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ডলে, এসিড দিয়ে ঝলসে বিবর্ণ-রংহীন বানিয়ে ছেড়ে দিতাম। ভার্সিটির স্টুডেন্ট হলে তো কথাই নেই। চুড়ান্ত ওয়াশ দিতাম। মিয়া ভার্সিটিতে পড়ো!! নামাজ পড়ো, পুজা করো, কেন করছো,কি করছো না বুঝেই করবা, চলবা আর সমাজে গিয়া ভাব নিবা যে “খুব শিক্ষিত হইছি গো” তা হবেনা। অসহ্য লাগতো এই সিস্টেম আর মানুষের অবিরাম ভন্ডামী। এখনো লাগে।

এভাবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার এক্সাম পার হয়ে গেলো। পড়া কিন্তু থামেনি। সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট কানেকশান। ধুমিয়ে চলছে ডকুমেন্টারী দেখা। এর মাঝেইএকদিন Atheism and Theism নিয়ে এক লেকচার দেখা হয়ে গেলো। খ্রীস্টান প্রফেসর এত এত সুন্দর করে লজিক দিয়ে সব কিছু বোঝালেন যে নড়েচড়ে বসলাম। ভাবনার নিস্তরঙ্গ পুকুরে অনেকদিন পরে তীব্র ঢিলের আঘাত! এইবার Theism এর লজিকের পিছে লাগলাম নিউট্রাল মাইন্ড নিয়েই। এর সাথে একাডেমিক স্টাডি হেল্প করছিলো ইভোলিউশান নিয়ে ভুল ধারণাগুলোর দরজায় আঘাত করতে। সংশয়বাদী মন বারবার বলে উঠতে চাইলো, স্রস্টা কি সত্যিই আছেন তাহলে? আর অহংকারী মন বারবার তার টুটী চেপে ধরছিলো।

কি যে কষ্ট এই নিউট্রালি চিন্তা করা! কি যে যন্ত্রণা এই একা একা মানসিক যুদ্ধ করতে থাকা। এত্ত এত্ত অসহায় লাগা সেই অনুভূতি আর দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ করে যাওয়া। কেউ পাশে নেই। কেউ না। বারবার শুধু অহংকারী মন “ধর্ম ভূল, স্রস্টা ভুল” বলে চিৎকার করে ওঠে আর বলে, “শোন, তুমি যা জানো তাই ঠিক। আরো ভালো করে Atheism নিয়ে স্টাডি করো, করতেই থাকো। এইসব সংস্কার, ফালতু সংস্কার।” দিনরাত মাথায় খালি আর্গুমেন্ট আর কাউন্টার আর্গুমেন্ট ঘুরতো। স্রস্টা যে নেই সেটাই বা কনফার্ম করি কি দিয়ে? সায়েন্টিস্টরা কি বলেন? Macro-Evolutionist Scientist রাতো এই ব্যাপারে কিছু Unproved ধারণা কপচিয়ে Chaos-Agent দের উস্কে দেয়। অথচ এই থিওরীগুলো থিওরীই শুধু। হাতে কলমে কাজ করে, অবজার্ভেশানে রেখে রেজাল্ট পাওয়ার জায়গা এটা নয়। বাকি থাকলো দর্শন। শুধু ভাবনা দিয়ে, থট এক্সপেরিমেন্ট করে যে কত্ত অসাধারণ জিনিস বের হয়ে আসে তা সবাই জানে। সায়ন্সের শুরুটাওতো দর্শন থেকেই। শুরু হলো দর্শন যুদ্ধ।

পড়তে পড়তে একটা উপলব্ধির শুরু হলো। আমি আসলে কিছুই জানিনা, কিচ্ছুনা। অহংকারের পাহাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেলো। দর্শন আর কমনসেন্সের যুদ্ধে নাস্তিক্যবাদ হার মানলো। আমরা কোনকিছু দেখে, ভালোভাবে অবজার্ভ করে, বারবার দেখে তারপর একটা ডিসিশানে যখন আসি তখন সেটাকে সায়েন্টিফিক অবসার্ভেশান বলি। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের কমনসেন্স আর ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেই কাজে লাগাই। ধরুন আপনাকে আমারএন্ড্রয়েড ফোনটা দেখালাম। তারপর বললাম আমার এন্ড্রয়েডটা সৌদি আরবের মরুভূমিতে কুড়িয়ে পেয়েছি। এত বালি আর তেল এত্ত এত্ত মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে ঝড়ো হাওয়া আর জলে,তাপে আর শৈত্যে, বজ্রের আঘাতে প্রথমে ধীরে ধীরে সিলিকন আর প্লাস্টিক, তারপর আরো মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে অন্যান্য পার্টস, ব্যাটারী ইত্যাদিতে বিবর্তিত হতে হতে হতে হতে আজকের এই টাচস্ক্রীণড-এন্ড্রয়েডে Evoluted হয়েছে। Samsung লেখাটা যে খোদাই করা দেখছেন, সেটাও এভাবেই এসেছে ভাই। বিশ্বাস করেন ভাই।আপনার দুটি পায়ে পড়ি ভাই, প্লীজ বিশ্বাস করেন। আপনি বিশ্বাস করবেননা। কেন?কেন করবেননা? কারণ, আপনার অব্জার্ভেশান বলে এটা Absolutely Impossible. তাই? একটা জড় পদার্থথেকে আরেকটা জড় পদার্থ এভাবে তৈরী হওয়ার দাবীকে আপনি ইম্পসিবল বলছেন, যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ চাইছেন আমার দাবীর, ভালো ভালো, গুড গুড। এইতো সায়েন্টিফিক মাইন্ড। যেখানে একটা জড় (বালি,তেল ইত্যাদি)থেকে আরেকটা জড়ই(মোবাইল) তৈরী হতে পারেনা, অসম্ভব, সেখানে জড় থেকেএকটা কোষের মত অসাম অর্গানাইজড আবার রিপ্রোডিউসিবল অর্গানিক ডিভাইস নিজে নিজে এমনিএমনি তৈরী হতে পারে? সম্ভব? আপনি বুদ্ধিমান হলে অলরেডী দুইদিকে মাথা নেড়ে “না, না” বলছেন,আর অন্ধ বিতার্কিক হলে কাউন্টার আর্গুমেন্ট হাতড়ানো শুরু করেছেন। প্রিয় অন্ধ বিতার্কিক, আপনি আপনার অন্ধকূপে হাতড়াতে থাকুন আজীবন, ভাব নিয়ে নিজে যা জানেন তাকেই শুধু সত্য বলে মেনে যান গলার জোরে আর অহংবোধে, নিজের গোলকধাঁধায়। ততক্ষণে আমরা আরেকটু আলোকিত হয়ে নিই, কেমন?

যেহেতু এত্ত সফিস্টিকেটেড একটা জিনিস এভাবে নিজে নিজে হয়ে যেতেপারেনা, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসতে পারেনা, তার মানে আমাদের কমন অবজার্ভেশান অনুযায়ী এর একজন স্রস্টা আছেন। এই দুনিয়া, প্রাণজগতের মাঝে এত্ত অর্ডার আর ডিজাইন, অর্ডার মেনে চলা বিশাল ইউনিভার্স থেকে শুরু করে ছোট্ট ইলেক্ট্রন-প্রোটন সবকিছু একজন অসাম অপার্থিব ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারের দিকেই ইন্ডিকেট করছে অবিরাম। কাজেই স্রস্টা আছে, থাকতেই হবে। আবার বাই ডিফল্ট একজনের বেশি স্রস্টা থাকা অসম্ভব। দর্শন, যুক্তি আর নিউট্রাল কমনসেন্স খাটালেই বুঝা যায় একজনের বেশি স্রস্টা থাকলে এই এর সুন্দর Order আর Natural Law থাকতোনা, Chaos এ ভরে থাকতোপুরো ইউনিভার্স। কিন্তু তা তো না! সব তো কি সুন্দর সিটেম আর অর্ডার মেনে চলছে। স্রস্টা তাহলে একজনই। তিনি অপার্থিব। সৃষ্টির কোন গুণাবলী তাঁর নেই, থাকতে পারেনা। কারণ,যদি থাকে তাহলে তাকে সৃষ্ট হতে হবে। তাকে যে সৃষ্টি করবে তাকে তাহলে আরেকজন সৃষ্টিকরতে হবে, তাকে আবার আরেকজন…এভাবে চলতেই থাকবে অসীম পর্যন্ত। এর কোন শেষ নেই।

সহজ করার জন্যে একটা এক্সাম্পল দিই। মনে করুন, আপনি একজন ট্রাক ড্রাইভার। গাড়ির ইঞ্জিন রাস্তায় হঠাৎ বিগড়ে গেলো। ঠেলে ঠেলেই আধা মাইল দূরের গ্যারেজে নিতে হবে। ধাক্কা দেয়া দরকার। একজনকে ডাকলেন।

তিনি বললেন,

“হোক্কে ভাইয়া। নো প্রবলেমো। আমি ধাক্কা দিমু, তবে যদি আমার আরেকজন ফ্রেন্ড রাজি হয় তারপর দিমু, নইলে না।”

তাঁর ফ্রেন্ডকে বললেন ব্যাপারটা।

সেই ফ্রেন্ডও উত্তর দিলো,

“হোক্কে ভাইয়া। নো প্রবলেমো। আমি ধাক্কাদিমু, তবে যদি আমার আরেকজন ফ্রেন্ড রাজি হয় তারপর দিমু, নইলে না।”।

তাঁর ফ্রেন্ডকেও খুঁজে বের করে রিকুয়েস্ট করলেন। সেও একই কথা জানালো। তাঁর আরেকটা ফ্রেন্ড রাজি হলে তিনি ধাক্কা দিবেন।

এভাবে যদি চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, ফ্রেন্ডের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে অসীম পর্যন্ত। ধাক্কা আর দেয়া হবেনা। গাড়িও আর কোনদিন আধমাইল দূরের গ্যারেজে যাবেনা। Right?

এভাবে স্রস্টাও যদি আরেকজন স্রস্টা দ্বারা, সেই স্রস্টাও আরেকজন স্রস্টা দ্বারা তৈরী হতে হয় তাহলে তা অসীম পর্যন্ত চলতেই থাকবে, কাজেই কিছুই আর সৃষ্টি হবেনা, সৃষ্টির মাঝে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের ছাপ পাওয়াতো সুদূর অস্তাচল। কিন্তু সৃষ্টি যেহেতু আছে, তাতে স্রষ্টার ইন্টেলিজেন্সের ছাপও পাওয়া যায় খেয়াল করলেই, তার মানে স্রস্টাও আছেন। কিন্তু সেই স্রস্টা যদি আমাদের এই লাইফে দেখা কোন কিছুর মতই না। কারণ, যদি কোন কিছুর মত হয় তাহলে তাকে সৃষ্টি হতে হবে আরেকটা ইন্টেলিজেন্স দ্বারা, তাকে আবার আরেকজন দ্বারা, এভাবে অসীম পর্যন্ত চলতেই থাকবে, ফলে আমরা আর কোন সৃষ্টিই দেখবোনা। তাইনা? কিন্তু,সৃষ্টিতো আছে। তার মানে হলো, স্রষ্টা আছে, তবে সেই স্রস্টা আমাদের দেখা কোনকিছুর মত না,কোন সৃষ্টির মত না। কোন মূর্তির মত না, ফুটবলের মত না, হাত পা চোখওয়ালা না, মোটকথা আমরা যেভাবে ভাবতে পারি তিনি সেরকম নন (কারণ, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের বাইরে ভাবতে পারিনা। একটা কল্পনার আনকমন প্রাণী তৈরী করার ট্রাই করতে পারেন। তাহলেই দেখবেন সেখানে আপনি শুধু আপনার পরিচিত জগত থেকেই উপাদান নিয়ে প্রাণীটাকে সাজাচ্ছেন। স্রস্টা পরিচিত জগতের কোন উপাদান দ্বারা তৈরী হতে পারেননা।) তাঁকে হতে হবে Self-sustaining, Powerful and Intelligent. কারণ, তিনি কারো মুখাপেক্ষি হতে পারেননা। Self-fulfilling না হলে তাকে কে Fulfill করবে? তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি (কারো কাছ থেকে জন্ম নিলে জন্মদাতাকে কে জন্ম দিলো এরকম প্রশ্ন আবার অসীম পর্যন্ত চলতে থাকবে) কাউকে জন্মও দেননি। একজন স্রস্টার এই গুণগুলো থাকতে হবে।

স্রস্টাতো তাহলে মানুষকে পথ দেখানোর জন্যে অনেক ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়েছেন শুনেছি। সেগুলো যাচাই করে দেখি কোনটা স্রষ্টাকে ঠিকভাবে বর্ণণা করে। আশেপাশে পাওয়া ধর্মগুলোকেই টার্গেট করা যাক।

হিন্দুধর্মঃ

ধর্মগ্রন্থের মাঝে আছে বেদ ও গীতা। এখানে আছে অবতারবাদ। অবতারবাদ অনুযায়ী স্রস্টা নিজেকেই মানুষরুপে দুনিয়াতে পাঠান। মানুষ সেলফ সাস্টেইনিং না, তাকে সৃষ্টি হতে হয়। একজন স্রষ্টা একই সাথে সৃষ্ট আবার স্রষ্টা দুটোই হতে পারেননা যুক্তি অনুযায়ীই। কাজেই এই ধর্ম কোন যুগ বা কালে সত্যিকারের পথপ্রদর্শক হিসেবে যদি স্রস্টার কাছে থেকে এসে থাকে, তবুও এটা গ্রহণযোগ্য না। কারণ, এখানে ঘাপলা ঢুকে গেছে শিওর। এটা নিঃসন্দেহে Nullified.

খ্রীস্টানধর্মঃ

মূল ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। এদের আবার দুই ভাগ। একভাগ অনুযায়ী স্রস্টার সন্তান হচ্ছে যীশু (বা ঈসা নবী)।

যীশু মানুষ ছিলেন। লজিক অনুযায়ী স্রস্টার সন্তান মানুষ হতে পারেনা। কারণ, মানুষ সেলফ সাস্টেইনিং না, তাকে সৃষ্টি হতে হয়। একজন স্রষ্টা একই সাথে সৃষ্ট আবার স্রষ্টা দুটোই হতে পারেননা যুক্তি অনুযায়ীই। এছাড়াও, ইতিহাস বলে এরা নিজেরাই ভোটাভুটির মাধ্যমে বাইবেল কে ইচ্ছেমতো বদলে নিয়েছে। বাইবেলের বদলানোর কাজ কয়েকজন করায় এর নানান রকম এডিশান পাওয়া যায়। কাজেই এই ধর্ম কোন যুগ বা কালে সত্যিকারের গাইডেন্স হিসেবে যদি স্রস্টার কাছে থেকে এসেও থাকে, তবুও এটা আর গ্রহণযোগ্য না। কারণ, এখানেও ঘাপলাঢুকে গেছে শিওর। এটাও নিঃসন্দেহে Invalidated.

বৌদ্ধধর্মঃ

এটা নিয়ে খুব বেশি পড়াশোনা করিনি। যা পড়েছি তাতে মনে হয়েছে এটা একটা দর্শন মাত্র। স্রস্টার প্রতি অভিযোগের রাশিমালা নিয়ে এই ধর্মের অবতারণা। শুধুমাত্র একজন মানুষের দর্শন নিয়ে এই ধর্ম বেড়ে উঠেছে, স্রস্টার কোন ইনভলভমেন্ট এই ধর্মে আমি পাইনি। এটাও তাই বাদ দিয়েছি।

ইসলামঃ

মূল ধর্মগ্রন্থ আল-কুরান। এটি অনুযায়ী স্রস্টা একজন। এটি বলে স্রস্টার আকার কল্পনা করা যায়না। তিনি self-sustaining. তাঁকে কেউ জন্ম দেয়নি, তিনিও কাউকে জন্ম দেননি। এটা সবক’টা লজিককে Fulfill করছে। এছাড়াও এটা মানুষের সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের কাছে আসা অন্যান্য Revelation এর কথা বর্ণণা করে, তারপরো মানুষের অন্য দিকে ছুটে যাওয়া, ভূল উপাস্য (যিশু, দূর্গা, কালী, মাজার ইত্যাদি) নির্বাচন, ভূলে ডুবে যাওয়ার ইতিহাস বর্ণণা করে। এটা এই দাবীও করে যে এটা জগতের ধ্বংস পর্যন্ত অবিকৃ্ত থাকবে। এই দাবীর পর ১৪০০বছর পার হয়ে গেছে, এখনো একটি অক্ষর এদিক ওদিক হয়নি। আর এর বার্তাবাহক যেদিন শেষ হজ্জের ভাষণ দিয়েছেন সেইদিন এই কুরানেই আল্লাহ ফাইনাল ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন,

“This day I have perfected your religion for you, completed My favour upon you, and have chosen for you Islam as your religion.” (1)

এই ফাইনাল রিভিলেশান আল-কুরানের মাধ্যমেই মহান স্রষ্টা একমাত্র জ্ঞানঅর্জন করে, যাচাই বাছাই করে, মাথা আর বিবেক বুদ্ধি খাটানোর মাধ্যমে এই পথ গ্রহণ করার আহবান জানান দুনিয়ার সব মানুষকে। প্রত্যেকটা মানুষকে। এই পথের নাম শান্তি বা ইসলাম। এই শান্তির পথকে, এই একমাত্র টিকে থাকা সত্যিকার পথকে যেসব মানুষ খুঁজে, জেনে, মেনে চলেন তাদের মুসলিম বলে। কাজেই একজন মানুষ মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই স্রস্টা আর তাঁর বার্তাবাহকের [মুহাম্মাদ (সা)] কথা পড়ে, বুঝে, জেনে, মেনে হতে হবে। এখানে কোন শর্টকাট নেই। জন্মসূত্রে নামের আগে একখানা “মোহাম্মদ” থাকলেই সে মুসলিম হয়ে যাবেনা। এইখানে (ইসলামিক) জ্ঞানার্জনকে এবং সেই অনুযায়ী জীবনধারণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কাজেই, মুসলিম হলে অবশ্যই এর বিধি বিধান জানতে হবে, ফলে পড়তে হবে, এবং অবশ্যই অবশ্যই নিজের জীবনে কুরআনকে প্রতিফলিত করতে হবে।

12

সব সত্য জেনে শুনেও যেসব মানুষ সমাজেরভয়ে, অহংকারে, নির্যাতনের ভয়ে ইত্যাদি নানা রকম কারণে এক স্রস্টার পাঠানো এই জীবনব্যবস্থা বিশ্বাস করেনা, বিশ্বাস করলেও নিজের জীবনে মানেনা, বিরোধীতা করে আর তাই অবিশ্বাসীদের চাইতে এইসব ভন্ডদের শাস্তি হবে আরো ভয়াবহ। এখানে বিচার-কে করা হয়েছে সুক্ষ্ম হতে সুক্ষ্মতর। নিখুঁত হতে নিখুঁততর। আর এটাও সঠিক পথের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক বৈশিষ্ট্য।

আমার এই পথে যাত্রা শুরু হলো। হাঁটতে হাঁটতে জানলাম কুরআন নিজেই একটা মিরাকেল। শেষদিন পর্যন্ত মানুষের এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এর মিরাকেল আবিস্কার হতেই থাকবে, হতেই থাকবে। এর সবচাইতে বড় Awesomeness হচ্ছে এর Miraculous Language। আরবী না জানলে এর রিয়েল মিরাকেল বোঝা সম্ভবই না। সেই আরবী শেখার পথে আমি মাত্র যাত্রা শুরু করলাম। আমি আমার ফিলোসফারস স্টোন টা খুঁজে পেয়েছি। ইসলাম নামের সেই পরশ পাথর টি আমাকে বদলে দিয়েছে, প্রতিদিনই বদলে দিচ্ছে একজন সোনালী মুসলিমে। সত্যিকার মুসলিমে। এখন শুধু পথটা ধরে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকা, নিজেকে পূর্ণ করার চেষ্টা করতে থাকা, মানুষকে সত্যটা জানানোর চেষ্টা করতে থাকা।

অনেক কথাতো বললাম। ইসলামে আসার পর সেই হই-হই করে মারতে আসামানুষগুলোকে, সমাজকে যখন হাসিমুখে বলতে গেলাম, জানাতে গেলাম সত্যের কথা, বোঝাতে গেলাম, সেই তারা এরপর কি করলো জানেন? থাক, আজ না। এই বিশাল ভন্ড আর করাপ্টেড সমাজের কথা, সেই Gotham Cityর গল্প আরেকদিন করবো ইনশাল্লাহ।

আপনি যদি এই দুনিয়ার কোন মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকেও সেই সুমহান সত্যের পথে স্বাগতম, স্বাগতম ইসলামের পথে, স্বাগতম দুনিয়ার চাকচিক্য, প্রদর্শনী,অশ্লীলতা আর গোলামী থেকে মুক্তির পথে, স্বাগতম মানবতার পথে।

স্বাগতম স্রস্টার নিজের দেখানো সত্যের পথে।

২৩শে নভেম্বার, ২০১৩।

রাত ৩টা বেজে ৩০ মিনিট।


রেফারেন্সঃ

  1. Sura Mayeda (Ayat: 3)

About মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর

আমি মুহাম্মাদ তোয়াহা আকবর। একাডেমিক পরিচয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন বায়োটেকনোলজিস্ট। আগ্রহ বিজ্ঞানে এবং গবেষণায়। তারচেয়েও বেশি পড়ানোয়। নৈতিক এবং আদর্শিক জীবনে একজন মনেপ্রাণে মুসলিম। নাস্তিকতা ছেড়ে আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’আলার অশেষ করুণা আর দয়ায় ইসলামের আলো চিনে এ পথে আসতে পেরেছি ২০১২ তে। এখন শিখছি। আরো বহু দূর পথ পাড়ি দিতে হবে জানি। অনন্তের জীবনের পাথেয় কুড়োতে বড্ড দেরী করে ফেলা একজন দূর্ভাগা হিসেবে নয়, বাঁচতে চাই সোনালি দিন গড়ার প্রত্যয়ে। ক্ষণিকের বালুবেলায় যে কটা মুক্তো কুড়োতে পারি সেই তো আমার লাভের খাতার শব্দমালা। হাঁটার পথে একটা দুটো মুক্তোর কথা, উপলব্ধির কথা লিখবো বলে এখানে পতাকা পুঁতেছি। আমি থাকবো না একদিন। আমার খুঁজে পাওয়া কিছু মুক্তো হয়তো থেকে যাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে। হয়তো হবে কারো আলোর মশাল। আর সে আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

5 Responses to যাত্রা শুরুঃ একটি অন্যরকম পাথরের গল্প

  1. adib says:

    দারুণ—-

    Like

  2. আপনার লেখাগুলো ফেসবুকে শেয়ার করা দরকার। মাশাল্লাহ! অসাধারণ লেখার হাত আপনার। ফেসবুকে একাউন্ট আছে কি আপনার?
    جزاك الله خيرا

    Like

  3. জ্বি আছে ভাইয়া। محمد طه اکبر এই নামে সার্চ দিলেই পাবেন ইন শা আল্লাহ।

    Like

  4. tousif16 says:

    তোয়াহা ভাইয়া আপনি মুক্তমনা ব্লগে লিখেন। উনাদের যে যুক্তি গুল আছে ইনশা’আল্লাহ আপনি ভাংতে পারবেন।

    Like

Leave a comment